অনেক দেশে সামরিক বাহিনী ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে, গণতন্ত্রকে সাময়িকভাবে স্থগিত করতে এবং ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ব্যবহার করছে। এখন পরিবেশগত সংকট সামরিক হস্তক্ষেপ এবং সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ন্যায্যতা দিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির তীব্রতা এবং ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করছে, তাই আমরা আরও ঘন ঘন জরুরী অবস্থার সম্মুখীন হবো। এর অর্থ হ’ল সামরিক বাহিনীর জরুরী ক্ষমতা এবং গণতন্ত্রের সাময়িক স্থগিতাদেশের ঘটনা আরও ঘন ঘন ঘটবে। বেশ কয়েকটি দেশে এই ক্রমাগত জলবায়ু জরুরী অবস্থাগুলি গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে ক্রমাগত স্থগিত করার একটি খুব বাস্তব ঝুঁকি রয়েছে – জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করতে এবং জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একই গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োজন।

ঘূর্ণিঝড় মোকা যখন ১৪ মে, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশের উপকুল এবং মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে, তখন ক্যাটাগরি-ফাইভ গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের কারণে রাখাইন রাজ্যে মর্মান্তিক প্রাণহানি এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। রাজধানী শহর সিত্তওয়ের অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

এটি ভালভাবে উপলদ্ধি করা যায় যে ঘূর্ণিঝড় মোকার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির মানব-সৃষ্ট (নৃতাত্ত্বিক) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা কম উপলদ্ধি করা যায় তা হ’ল এই চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সংঘঠিত মৃত্যু, ধ্বংস এবং বাস্তুচ্যুতির ব্যাপ্তি উপর গভীর প্রভাব ফেলে।

উইমেনস পিস নেটওয়ার্ক, যারা সাহসের সাথে মিয়ানমারে নৃশংস দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে রিপোর্ট করে আসছে, ১৬ মে একটি জরুরী ব্রিফিং করেছে যা ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবের মূল্যায়ন করেছে। সামরিক জান্তা তার আরো রাজনৈতিক দমন-পীড়নের জন্য ঘূর্ণিঝড়টিকে যে উপায়ে ব্যবহার করেছে তা ব্রিফিংটি পর্যবেক্ষণ করেছে:

ঘূর্ণিঝড় মোকায় জান্তার প্রতিক্রিয়ার প্রতিবেদনগুলি সামনে আসতে শুরু করেছে, যা প্রকাশ করে যে জান্তা রোহিঙ্গা আইডিপিদের [আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের] সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে নসাৎ করেছে এবং তখন থেকে তাদের শিবির এবং আশেপাশের এলাকায় সাহায্যের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। এই ধরনের পর্যবেক্ষণ, আরো অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে, ১ ফেব্রæয়ারি, ২০২১-এর অভ্যুত্থানের চেষ্টার পরে রাখাইন রাজ্যে বর্ণবাদকে আরও জোরদার করার জন্য জান্তার কাজগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

রাখাইন রাজ্য এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে ঘূর্ণিঝড় মোকার বিধ্বংসী প্রভাব “সুবিধাজনক অবহেলা” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যায় মিয়ানমার থেকে তাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির কথা স্মরণ করে দেয়, যা জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল কর্তৃক মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত।

এখানেই আমরা জলবায়ুর বিপদাপন্নতা এবং সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসকারী জনসংখ্যার বিপদাপন্নতার মিল দেখতে পাই। পদ্ধতিগত রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার মাধ্যমে এই বিপদাপন্নতা বৃদ্ধি পায়। মানুষ শুধুমাত্র তাদের জীবনহানি, তাদের বাড়িঘর ধ্বংস, বঞ্চনা এবং বাস্তুচ্যুতই স্বীকার হয় না, তাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার বা সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ করে।

ঘূর্ণিঝড়ের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনার পর মানবিক সংকটে আমরা প্রায়ই দেখি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো সামরিক শাসনের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাকে ন্যায্যতা দেয়। প্রকৃতপক্ষে, কিছু ত্রাণ সংস্থা বিশ্বাস করে যে কেন্দ্রীভ‚ত কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা সাহায্যের জন্য আরও দক্ষ বিতরণ ব্যবস্থা। এটি এই সত্যটিকে উপেক্ষা করে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, এবং জনসম্পদ – মানবিক সহায়তা সহ – শক্তিশালী অভিজাত এবং তাদের বন্ধুদের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রথম স্থানে টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হল জনসম্পদ চুরি।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হ’ল, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে, মানবিক সংকট এবং মানবিক সাহায্য রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্র এবং/অথবা নির্দিষ্ট জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত জনসংখ্যা মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত। যেমনটি আমরা আজ মিয়ানমারে দেখছি, বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার যুদ্ধ মানবিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কারণ জটিল নয়। মানবিক সংকটের শিকার হতে এবং মানবিক সাহায্যের জন্য যোগ্য হতে হলে আপনাকে প্রথমে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

১৯৪৫ সাল থেকে আমরা বেশ কয়েকটি দেশে গণতন্ত্রের সমাপ্তির সূচনা দেখেছি (প্রায়শই বিদেশী হস্তক্ষেপ দ্বারা সমর্থিত) যেখানে জাতীয় বা উপ-জাতীয় স্তরে (রাজ্য, অঞ্চল, প্রদেশ) জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং রাস্তায় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সৈন্যরা ব্যারাকের বাইরে চলে গেলে, সামরিক জেনারেল এবং তাদের সন্তানরা রাজনৈতিক, বেসামরিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে দ্রুত অগ্রসর হয়।

এমনকি যদি একটি নির্বাচিত সংসদ বা কংগ্রেসের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা হয়, এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন পুনরায় শুরু হয়, সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক দলগুলির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং রাজনৈতিক, বেসামরিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে তাদের পদচারণা বজায় রাখে। জনগণের জন্য এটি একটি চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থা হয়ে ওঠে – একটি স্থায়ী সংকটে পরিনত হয়।

এই ক্রমাগত সংকটে “জলবায়ু সহনশীলতা”ও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। জলবায়ু সহনশীলতা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির জন্য ন্যায়সঙ্গত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য এবং মানুষের স্বাস্থ্য, জীবিকা এবং পরিবেশ সুরক্ষিত করা নিশ্চিত করার জন্য একটি সম্মিলিত দায়িত্বের সাথে সংপৃক্ত। বর্তমানে আমাদের সম্প্রদায়গুলিতে বৃহত্তর জলবায়ু সহনশীলতার জন্য রাজনৈতিক অভিজাতদের আহ্বানের অর্থ হল আমাদের কেবল পরবর্তী চরম আবহাওয়ার ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। সমষ্টিগত পদক্ষেপ এবং জবাবদিহিতার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিনতাই, এবং অধিকারের অনুপস্থিতিতে, জলবায়ু সহনশীলতা অর্থ হ’ল বিপদাপন্ন সম্প্রদায়গুলির আরো সহ্য করা। অথবা সরে যাওয়া।

বেশ কয়েকটি দেশে, অতি ডানপন্থীরা ইতিমধ্যে জলবায়ু অস্বীকার থেকে জলবায়ু আতঙ্কে স্থানান্তরিত হয়েছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় (বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামীণ সম্প্রদায়) সমর্থনে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা প্রকাশ করার একটি রাজনৈতিক সুযোগ দেখতে পান। এই নতুন সঙ্কটের মুখে অতি ডানপন্থীরা শক্তিশালী নেতৃত্বের আহŸানের পুনরাবৃত্তি করতে পারে – কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য একটি জনপ্রিয় শব্দ। জাতির প্রতি বাহ্যিক হুমকির প্রতিক্রিয়ায় প্রতিটি জরুরি অবস্থার মতো, জলবায়ু সংকটটি গণতন্ত্রের স্থগিতাদেশকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য অতি ডানপন্থীরা ব্যবহার করবে।

এই দ্রæত ও ব্যাপক বেগের জলবায়ু সংকটে আমরা চরম আবহাওয়ার ঘটনা, তাপ প্রবাহ এবং দাবানলের কারণে ক্রমাগত জলবায়ু জরুরি অবস্থার সম্ভাবনার মুখোমুখি হই। এটি “জলবায়ু হুইপল্যাশ (ঘন ঘন এবং দীর্ঘ স্থায়ী বন্যা ও খড়া)” দ্বারা অর্থাৎ একটি চরম আবহাওয়ার ঘটনা থেকে আরেকটি (খরা তারপর বন্যা; দাবানল এবং মুষলধারে বৃষ্টি) তীব্রতর হওয়া। যদি এরকম ঘটে তাহলে কি ক্রমাগত জরুরি অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে যেখানে গণতন্ত্রের স্থগিতাদেশ স্থায়ী হয়ে যাবে?

ডক্টর মুহাম্মদ হিদায়াত গ্রিনফিল্ড, আইইউএফ এশিয়া/প্যাসিফিক রিজিওনাল সেক্রেটারি